লিয়াকত হোসেন লিংকন
দু’টি গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো প্রকল্প সংস্কার ও বাস্তবায়নের ফলে উন্নয়ন বঞ্চিত পশ্চিম গোপালগঞ্জের তিনটি ইউনিয়নের মানুষের জীবনমানের পরিবর্তনের পাশাপশি বেড়েছে জীবিকার উৎস। দীর্ঘদিন ধরে ওই অঞ্চলের মানুষ উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে ছিল। তাদের মূল পেশা ছিল কৃষি, মৎস্য শিকার ও দিনমজুরি। বছরের ৩-৪ মাস তারা থাকতো কর্মহীন ও বেকার। কিন্তু সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের মধ্যদিয়ে এসব এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। জীবনযাত্রায় উম্মোচিত হয় নতুন দিগন্ত। গতি ফিরেছে মানুষের জীবনে। পেশায় এসেছে নানা বৈচিত্র। আগের পেশা ছেড়ে নতুন নতুন পেশায় ঝুঁকছে মানুষ। ফলে পরিবারে স্বচ্ছলতা বেড়েছে। একই সাথে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ফিরে এসেছে স্বস্তি ও উচ্ছ্বাস।
সরেজমিনে গিয়ে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, চলতি অর্থ বছরে রুরাল কানেক্টিভিটি ইনপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (আরসিআইপি) আওতায় গোপালগঞ্জের সদরের চন্দ্রদিঘলিয়া-মধুমতি বাজার পর্যন্ত প্রায় ১২ কি. মি. এবং ডি.ডি.আই.আর.ডব্লিউএস.পি প্রজেক্টের আওতায় গোপীনাথপুর-ঘাঘা-ধলইতলা পর্যন্ত ১১ কি.মি সড়কের সংস্কার ও প্রশস্থকরণের কাজ সম্পন্ন করেছে গোপালগঞ্জের স্থানীয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি)। এ কাজ দু’টিতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা ছিল ৪৪ কোটি টাকা। এই সড়ক দু’টির সংস্কার ও উন্নয়নের ফলে পশ্চিম গোপালগঞ্জের চন্দ্রদিঘলিয়া, শুকতাইল ও জালালাবাদ ইউনিয়নের অন্তত অর্ধলক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুফল পেতে শুরু করেছে। গোপালগঞ্জ সদরের এ তিনটি ইউনিয়নের মধ্যে সর্বপশ্চিমের ইউনিয়ন হল ১নং জালালাবাদ ইউনিয়ন। ভৌগলিক কারণে চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় অন্যান্য ইউনিয়ন থেকে পিছিয়ে ছিল এ জনপদের মানুষ।
জালালাবাদ ইউনিয়ন মূলত একটি নদী বিধৌত অঞ্চল। যার উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিক দিয়ে মধুমতি নদী প্রবাহমান। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে নাব্যতা হারিয়ে পলি জমে ইউনিয়নের চর ধলইতলা, চরঘাগড়া, মাটলা, ঘাঘা গ্রাম এখন চরাঞ্চল পরিচিতি লাভ করেছে। ৯০ দশকেও এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম যোগাযোগের মাধ্যম ছিল নদী পথ। লঞ্চ যোগে মানুষ গোপালগঞ্জ জেলা শহরে আসতো। বাজার-ঘাট ও কোর্ট-কাচারির কাজসহ প্রয়োজনীয় কাজ শেষে করে তারা দিনে দিনে বাড়ি ফিরতে পারতো না। এমনকি লঞ্চে যোগে এ অঞ্চলের মানুষ খুলনায় যাতায়াত করতে হতো। তাই শিক্ষা, চিকিৎসা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের মানুষ খুলনার, নড়াইল ও যশোর জেলার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। দু’টি সড়কের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ায় মধ্যদিয়ে জেলা সদরের সাথে পশ্চিম গোপালগঞ্জের যাতায়াত ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ফলে অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই। মানুষের জীবনে ফিরেছে গতি। জীবন মানের পরির্বতন সাধিত হয়েছে ।
গোপালগঞ্জ সদরের ১ নং জালালবাদ ইউনিয়নের খালিয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল মনসুর আহমেদ বলেন, ‘সড়ক দু’টির সংস্কার ও প্রশস্থকরণের ফলে আমাদের এলাকার বিরাট জনগোষ্ঠির জীবনে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। আমরা এখন বাড়ি থেকে দ্রুত, কম খরচে, অতি সহজে চন্দ্রদিঘলিয়া, শুকতাইল, বড়ফা, ছোটফা, খালিয়া, মধুমতি বাজারে যেতে পারি। কম সময়ের মধ্যে দ্রুত গতির যানবাহনে গোপালগঞ্জ শহরে এসে স্বাচ্ছ্বন্দে বাজার সওদা করে এবং ডাক্তার দেখিয়ে আবার বাড়িতে ফিরতে পারছি। এছাড়া, পার্শ্ববর্তী লোহাগড়া উপজেলা দিয়ে নড়াইল জেলাসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে আমাদের যোগাযোগ সহজ হয়েছে। সড়ক অবকাঠামো বান্তবায়ন করায় আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।’
জালালাবাদ ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক ইউপি সদস্য নাসরিন ফেরদৌস বলেন, ‘যোগাযোগ অবকাঠামে উন্নয়নের ফলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা বাড়ি থেকে জেলা শহরের ভাল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপাড়ার করার সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলে আমাদের অঞ্চলে শিক্ষার হার বাড়বে। অন্যদিকে প্রসূতি মা, এমনকি গর্ভকালীন জটিলতার কারনে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হয়েছে। এতে মা ও শিশুর জীবন রক্ষা পাচ্ছে।’
মধুমতি বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী চাঁন মিয়া বলেন, ‘উন্নত সড়ক যোগাযোগের কারণে আমাদের অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য, ক্ষুদ্র শিল্প পণ্য ও অন্যান্য উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা সহজ হয়েছে। এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোল্ট্রি খামার গড়ে উঠছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজারে নিয়ে গিয়ে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। এতে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার পাশপাশি মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ছে।’
জালালাবাদ ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের মারুফ মিয়া, ছাটফা গ্রামের মেহেদী হাসান, বড়ফা গ্রামের সুরুজ মোল্লা বলেন, ‘সড়ক দু’টির সংস্কার ও উন্নয়নের ফলে পশ্চিম গোপালগঞ্জের তিনটি ইউনিয়নের মানুষের জীবনের গতি বেড়েছে। এসব সড়কে এখন দ্রুত গতির যানবহন চলাচলের জন্য উপযুক্ত হয়েছে। আমরা এখন বাড়ি থেকে বের হয়ে সরাসরি ঢাকার গাড়িতে ওঠে রাজধানীতে যেতে পারি। আগে আমাদের কষ্ট করে চন্দ্রদিঘলিয়া গিয়ে ঢাকার পরিবহনে উঠতে হতো। একই সাথে উন্নত সড়ক ব্যবস্থার কারণে এ অঞ্চল পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।’
গোপালগঞ্জের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এহসানুল হক বলেন, ‘নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলটি অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন ও সংস্কারের ফলে এখানকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছে। এ অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষি পণ্য, মৎস্যজাত, প্রাণিজাত পণ্যগুলো সহজে বাজারজাত করতে পারবে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।’